শামস শামীম ::
দুর্ঘটনায় পঙ্গু একটি কুকুরের দেড় মাস ধরে সেবা করছেন রিকসা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা সুনামগঞ্জের এক যুবক।
কুকুরের খাবার ও ওষুধ বাবদ প্রতিদিন আয়ের একটি অংশ চলে যাচ্ছে তার। এর সঙ্গে পরিশ্রম ও অতিরিক্ত সময় অতিবাহিত হলেও এ নিয়ে আফসোস নেই অকৃত্রিম হৃদয়ের এই মানুষের। পারিবারিক আর্থিক দুরাবস্থার জন্য লেখাপড়া করতে না পারলেও তিনি পশু ও মানবপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পরিবার ও বন্ধুরাও জানে তার এমন জীবপ্রেমের কথা। আহত কুকুরের সেবার পাশাপাশি সমাজের অপ্রকৃতস্থ-ভবঘুরে মানুষের মধ্যেও খাবার বিতরণ করেন তিনি। কিভাবে আরো বেশি পশু ও সমাজের ভবঘুরেদের সেবা-শুশ্রƒষা করা যায় এটাই ভাবছেন এখন। এজন্য তিনি প্রশাসনের মাধ্যমে একটি জীবপ্রেমী একটি উদ্যমী টিম গঠনের দাবি জানিয়েছেন। এই টিম গঠিত হলে বিনাপারিশ্রমিকে সেবা দিতে প্রস্তুত থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ শহরের হাজিপাড়া পয়েন্টে জেলা পরিষদ নির্মিত যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে দেখা যায়, একজন তরুণ ও একজন তরুণী একটি আহত কুকুরকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এই দৃশ্যটি দেখে এই প্রতিবেদক তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা জানান, ‘অপ্রকৃতিস্থ মানুষ’ ও ‘কুকুরপ্রেমী’ এক বিশাল হৃদয়ের হতদরিদ্র যুবকের কথা। তারপর বিকেলে আবার ওই স্থানে গিয়ে দেখা যায়, রিকসাটি সড়কের পাশে রেখে কুকুরকে পানি পান করাচ্ছেন এক যুবক। তার গায়ে শাদা গেঞ্জি ও চেক প্যান্ট। মাথায় টুপি। পায়ে একজোড়া প্লাস্টিকের সস্তা সেন্ডেল। পোশাক-আশাকে অভাবী মনে হলেও খুবই পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল তাকে। ওই সময় দেখা যায়, দুর্ঘটনার পর থেকে নড়াচড়া করতে না পারা কুকুরটির নিচে ককশিট বদল করে নতুন ককশিট দিচ্ছেন, যাতে যাত্রী ছাউনিতে দুর্গন্ধ না ছড়ায়। হাত বুলিয়ে আদর করছেন কুকুরটিকে। আশপাশের কয়েকজন মানুষ দেখছেন সেই দৃশ্য। অনেকে নাক সিটকে পাশ কাটিয়ে চলেও যাচ্ছেন। অনেকে মন থেকে দোয়া করছেন যুবকটির জন্য।
কুকুরপ্রেমী এই যুবক সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের নোয়াগাও গ্রামের দরিদ্র কৃষক আলকাছ মিয়ার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান আক্তার মিয়া। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সবার ছোট আক্তার।
তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, ছোটবেলা থেকেই কুকুর ও অপ্রকৃতস্থ লোকদের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদের কথা। ছোটবেলায় পথের কুকুরকে পানি খাওয়াতেন, কুকুরকে মারধর করে আহত করলে বা দুর্ঘটনায় আহত হলে সেবা করতেন। পরিবারের লোকজন স্কুলে আসার জন্য যে ভাড়া দিতেন, সেটি দিয়ে পথের ভবঘুরেকে খাবার কিনে দিতেন। এ নিয়ে বন্ধুরা প্রথমে হাসাহাসি করলেও পরে তার জীবপ্রেমের কথা অনুভব করে তাকে সম্মান করেন বন্ধুরা। তার স্কুলেও পশুপ্রেম ও মানবপ্রেমের গল্প রটে যায়।
একবার বিরতিহীন গাড়িতে করে সিলেট যাচ্ছিলেন আক্তার। পথে গোবিন্দগঞ্জে একটি কুকুর দুর্ঘটনায় আহত হয়। তিনি বাস থেকে নেমে কুকুরকে শুশ্রƒষা করেন। খাবার ও ওষুধ কিনে খাইয়ে তারপর ঘটনাস্থল ছাড়েন। ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বসেছিলেন আক্তার। কিন্তু ফলাফল খারাপ হওয়ার পর পিতার সাধ্য না থাকায় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে সুনামগঞ্জ শহরে এসে রিকসা চালাচ্ছেন। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় সুনামগঞ্জের রাস্তাঘাট-লোকালয় ডুবে যায়। মহাপ্লাবনে প্রাণীদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। দুর্যোগে লড়াই করে মানুষ নিজেদের নিরাপদে নিতে পারলেও কুকুরগুলো সেই সুযোগ পাচ্ছিল না। একটুকু আশ্রয়ের অভাবে ভেসে যাচ্ছিল অনেক কুকুর। তখন আক্তার কোলে কাখে করে প্রায় শতাধিক কুকুরকে ডাঙায় নিয়ে রাখেন। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খাবার খাওয়ান।
এভাবে সুনামগঞ্জ শহরে অনেক ভবঘুরেকে যারা খাবারের জন্য হাহাকার করে তাদেরকে সাধ্য মতো খাবার দেন তিনি। ভবঘুরেদের যখন চিৎকার শোরগোল করে তখন মানুষ তাড়িয়ে দেয়, মারধর করে; আক্তার তখন তাদের ভাষা বুঝতে পেরে ক্ষুধা নিবারণে খাবার তুলে দেন।
প্রায় দেড় মাস আগে সুনামগঞ্জ শহরের মরাটিলা এলাকায় বেপরোয়া মোটরসাইকেল কুকুরটিকে গুরুতর আহত করে। একটি পা ভেঙে যায়। কুকুরটির শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। পঙ্গু হয়ে যায় প্রাণীটি। এই অবস্থা দেখতে পেয়ে রিকসাচালক আক্তার যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে নিজে রিকসা থেকে নেমে কুকুরটিকে বুকে তুলে নেন। পরে রিকসায় তুলে ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে খাওয়ান। কুকুরটির এই অবস্থা দেখে তার খুব খারাপ লাগে। রিকসা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহকারী আক্তার দিনে রিকসা চালিয়ে রাতে বাড়ি চলে যেতেন। কিন্তু পঙ্গু হয়ে যাওয়া কুকুরটির জন্য তিনি বাড়িতে না গিয়ে শহরের একটি মেসে ওঠেন। প্রতিদিন ৫-৬ বার কুকুরটির কাছে এসে সেবা করেন। এভাবে একমাস চলার পর রিকসা চালিয়ে মেসে থাকা, নিজের ও পরিবারের খাবার সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে ওঠে। তবে এসময় একটি লেপতোষকের দোকানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান কুকুরের প্রতি তার দরদ দেখে তিনিও দরদী হয়ে ওঠেন। এই দৃশ্য দেখে তার সঙ্গে গল্প করে এসব জানার পর তিনি আক্তারকে ফুটপাতে তৈরি নিজের দোকানে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এখন সেই দোকানেই রাতে থাকেন আক্তার।
এদিকে, নিয়মিত কুকুরটির সেবা করতে দেখে সুনামগঞ্জ শহরের নার্সিং পড়–য়া শিক্ষার্থী অন্তরা সেন বৃষ্টি এগিয়ে আসেন। তিনি যুবকটির সঙ্গে কথা বলে ও কুকুরটিকে দেখে নিজে ওষুধ, ইনকেজশন এনে সেবা দেন। এখন ৫ দিনের একটি এন্টিবায়োটিক কোর্স সম্পন্ন করাচ্ছেন তিনি। অন্তরা সেন বৃষ্টি বলেন, আমরা এমন এক সময়ে বাস করি যখন মানুষের সামনে মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, নির্বিকার হেঁটে যাচ্ছে মানুষ; প্রতিরোধ-প্রতিবাদ করছে না। আবার এই সময়ে দেখছি একজন দরিদ্র রিকসা চালক ভাই তার সর্বস্ব দিয়ে আহত কুকুরের সেবা করছেন। তার আয়ের একটি অংশের সঙ্গে মূল্যবান সময়ও চলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে কুকুরের মলমূত্রও পরিষ্কার করছেন। এই দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো এখনো অসম্ভব ভালো মানুষ আছেন আমাদের দেশে। আক্তার ভাই এমনই একজন ভালো মানুষ।
বৃষ্টি বলেন, আমিও এই মহান হৃদয়ের মানুষটির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে কুকুরের জন্য ওষুধ কিনে গত দুই দিন ধরে সেবা দিচ্ছি। কোর্সটি শেষ হলে আমি সিলেটে চলে যাবো। নতুনপাড়ার বাসিন্দা তমাল দে জানান, এই অসীম হৃদয়ের যুবকের সঙ্গে কুকুরটির চিকিৎসায় অংশ নিতে পেরে আমাদের ভালো লাগছে। এমন মানুষটির কাছেই কেবল সকল প্রাণের নিরাপত্তা সম্ভব।
লেপতোষক ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, গত দেড় মাস ধরে দেখছি আক্তার প্রতিদিন ৫-৬ বার কুকুরটিকে এসে সেবা দিচ্ছে। কখনো পানি খাওয়াচ্ছে, খাবার দিচ্ছে, গোসল করাচ্ছে। কখনো মলমূত্র পরিষ্কার করছে। তিনি বলেন, নিজের পরিবারের মানুষ একটানা কিছুদিন অসুস্থ থাকলে, বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করলে অনেকের বিরক্ত লাগে। কিন্তু আক্তারকে দেখছি একটি পশুর মলমূত্র পরিষ্কার করছে। যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায়। সে কুকুরটির সেবার জন্য বাড়িতে না গিয়ে শহরে মেসে থাকছে। এ কথা জানার পর আজ ১০-১২ দিন ধরে আমার দোকানে তার থাকার ব্যবস্থা করেছি। এখনো প্রতিদিন ৫-৬ বার এসে কুকুরটির সেবা করছে। এমন ভালো মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
আক্তার মিয়া বলেন, কুকুরের প্রাণ আমাদের মতোই। আমাদের সমাজের কাছাকাছি তার বাস। ছোটবেলা থেকেই আমি কুকুর ভালোবাসি। কুকুর যখন গরমে পানির জন্য ছটফট করে, আমি তখন বুঝতে পারি। আমি কুকুরকে পানি খাওয়াই। এভাবে ভবঘুরে যখন চিৎকার করে, শোরগোল করে, তখন বুঝতে পারি তার ক্ষুধার কথা। তখন সাধ্য মতো খাবার ও পানি দেওয়ার চেষ্টা করি। তিনি বলেন, আমার টাকা-পয়সা নেই, তবে বিবেক আছে। এ কারণে পশুর মলমূত্র পরিষ্কার করলেও বিরক্ত লাগেনা। এই কুকুরটাকে দেড়মাস ধরে সেবা করছি। এখনো হাটতে পারেনা। তবে আশা করি কিছুদিনের মধ্যে হাটতে পারবে। কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। আক্তার বলেন, আমি একটা স্বপ্ন দেখি সমাজের ভবঘুরে ও দুর্ঘটনা কবলিত পশুর জন্য স্থানীয় প্রশাসন একটি টিম করে দিবে। সেই টিমে আমি স্বেচ্ছায় কাজ করবো। কখনো ডিসি স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হলে এই কথাটি বলতে চাই আমি। আমি চাই সবাই জীবে দয়া করা শিখুক। তাহলে আমাদের মানবজীবন মহান হয়ে ওঠবে। আমি ভাড়া রিকসা চালিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করে ভবঘুরে ও অসহায় প্রাণীদের জন্য কিছু করতে পারছিনা - এটা আমার আক্ষেপ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
ভবঘুরে ও কুকুরের অকৃত্রিম বন্ধু রিকসা চালক আক্তার মিয়া
যে ছেলেটি ‘মানুষ’ শব্দটিকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে
- আপলোড সময় : ২৭-০৭-২০২৫ ০৯:৩৪:৪৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৭-০৭-২০২৫ ০৯:৩৯:০৬ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ